দেশের সাদা সোনা বলে খ্যাত মসলা জাতীয় গুরুত্বপুর্ন ফসল রসূন। এই রসূন এখন কৃষকের জন্য হয়ে উঠেছে অন্যতম অর্থকরি ফসল। বিশেষ করে চলনবিল অধ্যুসিত গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম , নাটোর সদর ,সিংড়া, চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া আর তাড়াশ উপজেলার মানুষের ঘরে ঘরে।আর এই রসুনের আবাদকে কেন্দ্র করেই চলনবিল অঞ্চলে চলে কৃষকদের মাঝে জমি লিজ থেকে শুরু করে সার, বীজ, সংগ্রহ – সংরক্ষন,, জমি তৈরী,শ্রমিক সংগ্রহ, বীজ রোপন, নিড়ানি, সেচ, মালচিংয়ের খর/উপকরন সংগ্রহ, উত্তোলন, ঝুটি বাঁধা,সংরক্ষন, বাজার জাতকরণসহ সারা বছরব্যপী চলে যত কর্মযজ্ঞ।
চলনবিলের মানুষ সাদা সোনা রসুনকেই এখন প্রধান ফসল হিসেবে সমধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।নাটোর জেলাসহ চলনবিলেএই রসুনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন হাট-বাজার,বানিজ্যিক কেন্দ্র এবং নারী-পুরুষ- শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের শ্রমবাজার এবং কর্মসংস্থান । রসুনের হাট-বাজার থেকে আসছে মোটা অংকের রাজস্ব।এসেছে অর্থনৈতিক সফলতা। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। বেড়েছে জমির বহুমুখি ফসলের চাষাবাদ। এছাড়াও বেড়েছে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত আর্থিক সংস্থা এবং ব্যাক্তি পর্যায় থেকে ঋনের প্রবাহের লেন-দেনের হার।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায় এ বছরে অনুকুল আবহাওয়া থাকায় সাদা সোনা বলে খ্যাত রসুনের বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে নাটোর জেলার ৭ উপজেলায় ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ হয়েছে, যা দেশের মোট আবাদের ২৯ শতাংশ এবং ফলন হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ২০৮ মেট্রিক টন যা দেশের মোট ফলনের ৪২ শতাংশ। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
এছাড়া পাবনা জেলায় আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৪৩০ হাক্টর জমিতে, উতপাদন হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন।দেশে মোট উতপাদনে ১৮ শতাংশ।শুধুমাত্র নাটোর আর পাবনা দুই জেলাতেই দেশের ৫০+শতাংশ রসুন উতপাদিত হয়েছে।
চলনবিল অঞ্চলে সাধারণত ইটালি,ঢাকাইয়া এবং পাটনাই জাতের রসুনের আবাদ করা হয়।তবে কৃষকের নিজস্ব উদ্ভাবিত হাজারি জাতের রসুন আবাদ করে বেশী ফলন হওয়ায় রসুন চাষীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে বলে রসুন চাষীদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে। খোঁজ করেও হাজারি জাতের উদ্ভাবকের খোজ পাওয়া যায় নাই। জানা গেছে হাজারি জাতের রসুন বিঘায় ৪০+ মন ফলন হয়। গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার হারুনর রশিদ জানান, হাজারি জাত নামে কোন রসুনের জাত সম্পর্কে তাঁর জানা নাই বা কৃষি দপ্তরের সার্টফায়েড কোন জাত না। এক শ্রেনির অসাধু ব্যবসায়ি মুনাফার লোভে হাজারি জাত নাম ব্যবহার করে কৃষকদের ঠকিয়ে অবৈধ মুনাফা লুটছে।
নাটোর জেলার ৭ উপজেলায় রসুন আবাদকৃত জমি ও আবাদকৃত জমিতে উতপাদনএর পরিমান হচ্ছে,২৮৮০ হেক্টর জমিতে ২৭ হাজার মেট্রিক টন, নলডাংগা ৪২৬ হেক্টরে ৩৯৩৬ মেট্রিক টন, সিংড়া ১০০৫ হেক্টরে ৯২৮৬ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুর ৭৩৭৫ হেক্টরে ৬৮ ১৪৫ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম ৮৯৯৩ হেক্টরে ৮৩০৯৫ মেট্রিক টন,লালপুর ১১০০ হেক্টরে ১০১৬৪ মেট্রিক টন এবং বাগাতি পাড়া উপজেলায় ১০৭৬ হেক্টরে ১০ হাজার মেট্রিক টন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নাটোর জালায় মোট রসুন উতপাদনের ৭২ শতাংশ উতপাদন হয় শুধুমাত্র বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায়, এর মধ্যে বড়াইগ্রমে ৩৫% এবং গুরুদাসপুরে ২৯%।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ হারুনর রশিদ জানান চলতি মৌসুমে আবহাওয়া রসুন চাষের অনুকুল থাকায় কৃষকরা জমিতে রসুন রোপন থেকে সেচসহ অন্যান্য সার্বিক ব্যাবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই ভালোভাবে উতপাদিত রসুন ঘরে উঠাতে এবং প্রয়োজনমত শুকায়ে নিজ নিজ পদ্ধতিতে সংরক্ষন করতে পেরেছে। এবারে রসুনের বাম্পার ফলন হওয়ায় এবং বাজারে শুরু থেকেই ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হয়েছে। তিনি আরও জানান কৃষি অফিস থেকে মাঠ পর্যায়ে রসুন চাষে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের কারগরি প্রশিক্ষন ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর ( খামার বাড়ি) এর অতিরিক্ত উপ পরিচালক ডঃ শামিম আহমেদ জানান,এবছর দেশে রসুনের আবাদ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে । আবাদকৃত জমিতে উতপাদন হয়েছে ৭ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। দেশে মোট উতপাদিত ৭ লাখ ২৪ হাজার মট্রিক টন রসুনের প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রক টন নাটোর ও পাবনা জেলার চলনবিল অধ্যুসিত এলাকাগুলোতে। রসুনের আবাদ করে কৃষকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় রসুনের আবাদের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। দেশে ২০২৩ সালে ১৬ ৭৪৫ হেক্টর জমিতে, উতপাদন হয়েছিল ৪৮,২৫৭ মেট্রিক টন এবং ২০২৪ সালে বেড়ে আবাদ হয়েছিল ১৮০০৫ হেক্টর , উতপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ২০১ মেট্রিক টন। ( দ্য ডেইলি ষ্টার, ১৩ মে/২৫ তারিখে প্রকাশিত আহমেদ হুমায়ুনের অনলাইন প্রতিবেদন )।
শেয়ার বিজ অনলাইন পোর্টালে ১৭/২/২৫ তারিখের চট্রগ্রামের প্রতিবেদক সাইফুল ইসলামের প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বছর জুড়ে রসুনের চাহিদা সাড়ে ৬ লাখ টন। দেশী রসুন পাওয়া যায় ৫ লাখ টন। বাকী দেড় লাখ আমদানিকৃত। সে তুলনায় নাটোর জেলাতেই উতপাদন হয় ৪৮ শতাংশ রসুন। চাষীরা জানান ,উতপাদিত রসুন সুষ্ট সংরক্ষনের ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হওয়ার আশংকায় ৩০-৪৮% রসুন হারভেষ্টিং সময়েই মধ্যসত্ত্বভোগিদের কাছে অল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষকরা।
সংরক্ষন বিষয়টিকে গুরুত্ত্ব অনুভব করে রাজনীতিবিদ ব্যারিষ্টার অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৩ এপ্রিল তারিখে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে নাটোরের গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের রসুন চাষিদের দুর্দশা: সরকারি ব্যর্থতা ও সমাধানের পথ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন,বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর গবেষণা অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রসুনের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এই উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চাষিরা লাভবান না হয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ, দেশে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা না থাকায় কৃষকদের বাধ্য হয়ে বাজারে কম মূল্যে রসুন বিক্রি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০৫টি কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে, যার ৯৫% আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু রসুন সংরক্ষণের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। এর ফলে প্রায় ৩০-৩৫% রসুন সংরক্ষণজনিত কারণে নষ্ট হয়ে যায়।পাবনার পিঁয়াজ চাষিদের সাফল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, কোল্ড স্টোরেজ এবং সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা তাদের আয় ৫০% পর্যন্ত বাড়াতে পেরেছেন। নাটোরের রসুন চাষিদের জন্যও এই মডেল কার্যকর হবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৯৪-৯৫ সালে চলনবিল অধ্যুসিত নাটোর জেলার গুরুদাসপুর এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার নিম্নাঞ্চলে কার্তিক মাসে বন্যার পানি নেমে গেলে কৃষি অফিসের পরামর্শ ছাড়াই কৃষকরা নিজস্ব উদ্যোগে এবং পদ্ধতিতে বিনা চাষে কাদায় রসুনের কোয়া রোপন করে ধানের লাড়া/খড় দিয়ে ঢেকে আবাদ করা শুরু করেন। নরম জমিতে বিনা চাষে রসুনের আবাদে উতপাদন খরচ কম হওয়ায় আর্থিকভাবে কৃষকরা লাভবান হয়। ফলে দ্রুত গতিতে রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসলের আবাদ ছেড়ে বিনা চাষে রসুনের আবাদ সম্প্রসারিত হতে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রামের কৃষক উদ্ভাবিত বিনা চাষে রসুন আবাদের পদ্ধতি গবেষনা করে সারা দেশের কৃষকদের উতসাহিত করে রসুনের আবাদের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।।
## আবুল কালাম আজাদ, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট