আহ! কী স্বাদ। আহ! কী মুধুর মিষ্টি। রসে টই টুম্বুর, স্বাদে অতুলনিয় লোভনীয় লিচুই হচ্ছে সবার প্রিয় নাটোরের “ মোজাফফর লিচু”।মনে হয় যেন “নাটোরের কাঁচাগোল্লা “ নাম শুনলেই জিহ্ববা রসে ভরে যায়। বলতে গেলে নাটোর জেলাতেই মোজাফফর জাতের লিচু দেশের মোট উতপাদনের ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ উতপাদন হয়।
মোজাফফরি জাতের লিচু আগাম জাতের হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি। তাই সারা দেশ জয় করেছে নাটোরের কাঁচা গোল্লার ন্যায় রসালো লাল টুক টুকে সবার প্রিয় মোজাফফর লিচু। নাটোরের মোজাফফর লিচু সারা দেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিদিন অর্ধশতাধিক ট্রাক লোড দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ চিটাগাং, সিলেট, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, খুলনাসহ সারা দেশে চলে যাচ্ছে।
নাটোরে কৃষি বিভাগ জানাচ্ছে ,এবারে অনুকুল আবহাওয়া থাকায় এবং কোনরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় লিচুর ফলন প্রায় দ্বিগুন বেশী হয়েছে। ফলের গুনগত মান এবং স্বাদও বেড়েছে। দাম বেড়েছে দ্বিগুন। লিচু চাষি, বেপারি, আরত ব্যবসায়ি এবং ইজারদাররা জানান, মে মাসের প্রথমে অপরিপক্ক ছোট গুটির লিচু ভাংগার সময় প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হতো ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা এখন অর্থাৎ ২৩ মে বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা। তারা জানান, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় লিচুর উৎপাদন এবং দাম যেমন বেড়েছে, তাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। জেলায় মোট লিচুর উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন। কিন্তু চাষী এবং বেপারিদের দাবি আবহাওয়া ভালো থাকার কারনে উতপাদন ১০ হাজার টন ছাড়ায়ে যাবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। উৎপাদন ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন । এর মধ্যে সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৬০ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গা উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৫ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে ৯০ মেট্রিক টন, সিংড়া উপজেলায় আবাদ ৯৮ হেক্টর ও উৎপাদন ৭৮৪ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুর উপজেলায় আবাদ ৪১০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম উপজেলায় আবাদ ৪০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩২০ মেট্রিক টন, লালপুর উপজেলায় আবাদ ১০৫ হেক্টর ও উৎপাদন ৮২৫ মেট্রিক টন এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৯৬ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদন হয়েছে ৭৬৮ মেট্রিক টন।
তরুন রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ গবেষক অধ্যাপক ব্যারিষ্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর নিজ ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১৩ মে লিচু বিষয়ে গবেষনামুলক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন” ,গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের মাটি ও মানুষের সঙ্গে লিচুর সম্পর্ক কেবল কৃষিনির্ভর নয়—এটি এই জনপদের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। বাংলাদেশের মোট লিচু উৎপাদনের প্রায় ৩৫ শতাংশ এই অঞ্চলেই হয়, যার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে মোজাফফর প্রজাতির লিচু।
লিচু এই অঞ্চলের প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের জীবিকার উৎস। গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামে প্রায় ২৮০০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়, যার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন। তবে দুঃখজনকভাবে, কৃষকের প্রাপ্য আয় বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম। মাঠ পর্যায়ে প্রতি ১০০ লিচুর দাম যেখানে ৩০০ টাকা, সেটি ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাজারে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়। এই বৈষম্যের মূল কারণ হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষক সংগঠনের অভাব। কার্যকর সমবায় ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা আজও অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে আছেন। শিল্প ও কৃষির মধ্যে একীভূত রূপান্তর ঘটানো হবে। লিচু থেকে জুস, জ্যাম, সিরাপ তৈরি করে দেশে এবং বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি করা হবে। এতে একশ লিচুর দাম ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে গুরুদাসপুরকে “লিচু ভ্যালি” হিসেবে গড়ে তোলা—যেখানে কৃষি হবে প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৃষকের সঙ্গে সরাসরি রাষ্ট্রের সংযোগ। আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে গুরুদাসপুরকে “লিচু ভ্যালি” হিসেবে গড়ে তোলা—যেখানে কৃষি হবে প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৃষকের সঙ্গে সরাসরি রাষ্ট্রের সংযোগ।হবে। “কৃষক উৎপাদক সংঘ” গঠন করে সরাসরি কৃষক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক লেনদেন চালু করা হবে। সরকার তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ক্রয়ব্যবস্থা চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং কৃষকের হাতে পৌঁছাবে ন্যায্য মূল্য।“
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. হারুনুর রশীদ বলেন, গুরুদাসপুরে এবার ২০৫টি বাগানে ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন। এখানকার লিচু সুস্বাদু হওয়ায় ঢাক-চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে যান এবং রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করেন। এবার গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে ১৪০ কোটি ২২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষি অফিস থেকে মাঠ পর্যায়ে অবস্থান করে নিয়মিত মনিটরিং এবং লিচু চাষি ও বেপারিদেরকে বাগানের পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষন ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এবারে আবহাওয়া লিচু চাষের অনুকূল হওয়ায় লিচুর গুনগত মান ভালো হয়েছে। গুটি,রং, স্বাদে-গুনে অতুলনীয় হয়েছে। বালাই এবং প্রাকৃতিক র্যোগে ক্ষ্যক্ষতি কম হয়েছে। যার ফলে লিচু ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। চাষি এবং ব্যবসায়িরা লাভবান হচ্ছে। ভোক্তারাও ঠকছেনা।
গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের মোজাফদর লিচুর জেলার একমাত্র সরকারি রাজস্ব অন্তর্ভূক্ত ব্রগংগা রামপুর কানুমোল্লার বটতলা অয়াথায়ী হাট লিচু আড়ত কমিটির ইজারাদার অনিসুর রহমান , রতন,জানান , চলতি মৌসুমে জেলার একমাত্র মোজাফফর সরকারি রাজস্ব খাতের বড় লিচুর হাট ঘিরে প্রায় ২০ টি আড়তের ইজারা মূল্য ডাকা হয়েছে ভ্যাটসহ ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা ভ্যাট বাদে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গত বছরের চেচয় ৬৫ হাজার টাকা বেশি। তাঁরা জানান, প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে লিচু বেচাকেনা চলছে। ক্রেতা, বিক্রেতা ও কৃষকদের থাকা, খাওয়াসহ অর্থনৈতিক লেনদেনের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে আড়ত কমিটির পক্ষ থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। পাশাপাশি মৌসুম জুড়ে থানা পুলিশও নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় মোজাফ্ফর জাতের লিচুর চাষ বেশি হয়। ৭ উপজেলার মধ্যে শুধু মাত্র গুরুদাসপুর উপজেলাতি ৪৪% লিচু চাষ এবং উতপাদন হয়।এছাড়া বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু চাষ হয়ে থাকে। এবার লিচুর উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
#সাংবাদিক ও কলামিস্ট- আবুল কালাম আজাদ